ভূত চতুর্দশী নামের মধ্যেই রয়েছে একটা গা ছমছমে অন্ধকারময় পরিবেশ। এই নামটি শুনেই বোঝা যাচ্ছে দীপান্বিতা কালী পূজার আগের দিন ভূত-প্রেতের একসঙ্গে সমাবেশ ঘটে।
হিন্দু শাস্ত্রমতে সারা বছর ধরে বিভিন্ন রকম আচার অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করা রেওয়াজ রয়েছে। তেমনি কালীপুজোর ঠিক আগের দিন ভূত চতুর্দশী পালন করা হয়। দীপাবলির পাঁচদিন ব্যাপী উৎসব হয়। দীপাবলি উৎসবের দ্বিতীয় দিনটিকে ভূত চতুর্দশী বলে উল্লেখ করা হয়। এটি হিন্দু পঞ্জিকা মতে কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালন করা হয়ে থাকে। হিন্দু গ্রন্থ মতে, এই দিন কৃষ্ণ ও সত্যভামা নরকাসুরকে বধ করেছিলেন। এই দিনটিতে ১৪ রকমের শাক একসঙ্গে রান্না করে খাবার নিয়ম রয়েছে। সেই সাথে সন্ধ্যাবেলায় ১৪ প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়ে থাকে।
কথিত রয়েছে, ভূত চতুর্দশীর দিন মর্ত্যলোকে অশুভ শক্তির আগমন ঘটে। এই দিনটি সম্পর্কে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায়। অনেক জায়গায় বলা হয়েছে, আজকের দিনে দৈত্যরাজ বলি পৃথিবীতে পূজো নিতে আসেন। তবে তিনি শুধু একা আসেন না, তার সাথে আসেন সহস্র ভূত এবং প্রেতাত্মা। অন্য কিছু ধর্মগ্রন্থ থেকে জানা যায়, এই দিনে দেবী কালির চামুন্ডার রূপে মর্ত্যে আসেন অশুভ শক্তির বিনাশ করতে। এছাড়া আরো অন্যান্য মত অনুযায়ী জানা যায়, পূর্ব পুরুষদের আত্মা এই তিথিতে মর্ত্যলোকে আসেন।
ভূত চতুর্দশী কিভাবে শুরু হলো:
পুরাণ মতে, দানবরাজ বলি যখন স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। এই রাক্ষসদের আক্রোশের শিকার হন দেবতাকূল। এই দানবরাজ বলির তাণ্ডব আটকানোর জন্যই বৃহস্পতি বিষ্ণুকে বামনের ছদ্মবেশ ধারণ করে আবির্ভূত হতে বলেন। এরপর তিনি বলির কাছে ৩ পায়ের সমান জমি ভিক্ষে চান। কিন্তু দানবরাজ বলি বুঝতে পেরে যান বামন আর কেউ নয়, সে স্বয়ং বিষ্ণু। তবে এটা জানার পরেও ছদ্মবেশী বিষ্ণুকে ভিক্ষা দান করেন। এরপরই দু পা দিয়ে স্বর্গ ও মর্ত্য দখল করে নেয় বিষ্ণু। এছাড়া নাভি থেকে বেরিয়ে আসা তৃতীয় পা দিয়ে দেবরাজ বলির মাথায় পা রাখেন। এরপরই দেবরাজ বলি পাতালে অবতরণ করেন। তারপর থেকেই পাতালেই বাস করেন বলি। সবকিছু জানার পরেও দানবরাজ বলি বিষ্ণুকে ভিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি বিষ্ণুর করুনার পাত্র হন। তখন তিনি বলিকে আশীর্বাদ করেন, প্রত্যেক বছর বছরে একবারের জন্য তিনি মর্ত্যে আসবেন পুজো নেওয়ার জন্য। এরপর থেকেই দীপান্বিতা কালীপুজোর আগের দিন ভূত চতুর্দশী উপলক্ষে দেবরাজ বলি পুজো নিতে মর্ত্যে আসেন এবং তার সাথে আসেন সমগ্র ভূত প্রেত। এই দিনটি ভূত চতুর্দশী নামে পরিচিত হয়ে আসছে।
১৪ প্রদীপ জ্বালানোর নিয়ম কেন:
আজকের দিনে অর্থাৎ ভূত চতুর্দশীর দিন অনেকের বাড়িতেই সন্ধ্যাবেলা চৌদ্দ পদীপ জ্বালানো হয়। কিন্তু অনেকেই জ্বালানোর আসল কারণ সম্পর্কে না জেনেই এই নিয়মটি পালন করে থাকেন প্রত্যেক বছর। আসুন জেনে নেওয়া যাক এর আসল কারণ কি :-
হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে, ভূত চতুর্দশীর দিন মৃত পূর্ব পুরুষরা মর্ত্যে নেমে আসেন৷ হিন্দু মতে বলা হয়, মৃত্যুর পর মানুষের দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। এই পঞ্চভূত হল আকাশ, মাটি, জল, হাওয়া এবং অগ্নি। প্রকৃতির এই পাঁচ উপাদানে মৃত ব্যক্তির আত্মা মিশে থাকে। এইজন্য ভূত চতুর্দশীর দিন আত্মাদের খুশি করতে এবং অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটানোর জন্যই ১৪ পদীপ জ্বালানো হয়।
চৌদ্দ শাক খাওয়ার নিয়ম :
প্রকৃতির মধ্যেই পূর্বপুরুষদের আত্মা মিশে থাকে বলেই প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা ১৪ রকমের শাক খাওয়া হয়। এবং সেই সাথে পূর্বপুরুষদের উৎসর্গ করা হয়। এই চৌদ্দ শাকের মধ্যে রয়েছে জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, ওল, পুঁই, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা ও শুষণী।
তবে হিন্দু শাস্ত্র বাদ দিয়ে ও বৈজ্ঞানিক মতে ১৪ শাক খাওয়ার এবং ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর কারণ সম্পর্কে অন্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেই ব্যাখ্যা অনুযায়ী বলা হয়েছে, যেহেতু গ্রীষ্মের পর শীতে প্রবেশ করছে। তাই কার্তিক মাসে শুরুতে এই সিজেন চেঞ্জ এর সময় বিভিন্ন রকম শারীরিক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এর জন্য চৌদ্দ শাক খাওয়ার মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার জন্য এই নিয়ম চালু করা হয়েছে।
অন্যদিকে, শীতকালের বিভিন্ন রকম পোকা মাকড় উপদ্রব ঘটে, তার জন্য প্রদীপ জ্বালানোর মাধ্যমে পোকামাকড়ে উপদ্রব থেকে বাঁচা যায়।
২০২৫ সালের ভূত চতুর্দশী পড়েছে ১৯ শে অক্টোবর রবিবার। প্রত্যেক বাড়িতে আজকের দিনে প্রত্যেক বছরের ন্যায় চৌদ্দ শাক খাওয়ার রিদি পালন হচ্ছে এবং সন্ধ্যাবেলা ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর মাধ্যমে অশুভ শক্তির বিনাশ করা হবে।