বৈষ্ণব পদাবলীতে বিদ্যাপতির কি অবদান রয়েছে? রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলার কোন অংশ ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।

রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা ও বিরহ এবং তাদের জীবন বৈচিত্র্য আমরা সবথেকে নিপুণ ভাবে যদি কোনো বই থেকে জানতে পারি, সেটা হলো বৈষ্ণব পদাবলী, যার অনেকটাই অবদান রয়েছে বিদ্যাপতির।

জেনে নেওয়া যাক, বৈষ্ণব পদাবলীতে বিদ্যাপতির সঠিক কি অবদান রয়েছে:-

পঞ্চদশ শতকের মধ্যযুগীয় মৈথিলী কবি ছিলেন এই বিদ্যাপতি। তিনি যে বৈষ্ণব পদগুলো লিখতেন সেগুলি সাধারণত ব্রজবুলি ভাষাতেই লিখতেন। জানা যায়, শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং বিদ্যাপতির এই বৈষ্ণব পদের লেখাগুলিকে গানের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। বঙ্গদেশে মানুষ চর্যাগীতির ভাষার চেয়ে এই ব্রজবুলি ভাষা খুব সহজে বুঝতে পারতেন। এইজন্যেই সকল মানুষের মনে বিদ্যাপতির বৈষ্ণব পদ অনেকটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

বিদ্যাপতি একসাথে অনেক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, শিক্ষক, কাহিনিকার, ঐতিহাসিক, ভূবৃত্তান্ত লেখক ও নিবন্ধকার। বিদ্যাপতি নিজের নাম ছাড়াও আরো দুটি নামে পরিচিত ছিলেন। নাম দুটি হল “মৈথিল কোকিল” এবং “অভিনব জয়দেব”।

পদাবলীর সাহিত্য ছাড়াও তিনি আরো অনেক বই রচনা করেছিলেন। তবে, বৈষ্ণব পদাবলীর যে দুটি ভাগের জন্য তিনি সব থেকে খ্যাতি লাভ করেছিলেন সেটি হল ‘মাথুর’ এবং ‘ভাবসম্মিলন’। এই বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের সূচনা ঘটে চর্তুদশ শতকে বিদ্যাপতির সময়কালে, তবে এই বৈষ্ণব পদ জনপ্রিয়তা লাভ করে ষোড়শ শতকে।

জানা যায়, বৈষ্ণব পদাবলীতে তিনি জয়দেবের ভাবাদর্শ এবং ভাগবতের লীলাকাহিনী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেছিলেন।

বৈষ্ণব পদাবলীর ‘মাথুর’ এবং ‘ভাবসম্মিলন’এই পদগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘মাথুর’ পদে আমরা জানতে পারি কৃষ্ণের বিরহে রাধার মানসিক অবস্থার কথা, রাধার বিরহের বিভিন্ন দিক এবং কৃষ্ণের প্রতি গভীর অনুরাগ। অন্যদিকে, ‘ভাবসম্মিলন’ পদাবলীতে রাধা-কৃষ্ণের মিলন এবং তাদের আনন্দ-অনুভূতির বর্ণনা রয়েছে।

বিদ্যাপতির ব্যক্তিগত জীবন :- বিদ্যাপতির স্ত্রী ছিলেন ভাবল্লভা, তবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন এবং দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। বিশেষভাবেই বিদ্যাপতির সাহিত্য কীর্তি এবং সেই সাহিত্যে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের যে বর্ণনা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তা অবিস্মরণীয়।

বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির অবদান:-
বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির অবদান বলে শেষ করার নয়। বিদ্যাপতি মূলত সাহিত্যকর্মের জন্যই বিশেষভাবে খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি তার চর্যাপদে পদগুলিতে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে শুধুমাত্র লীলা খেলার মধ্যেই না রেখে, ভক্তি রসের মাধ্যমে উপস্থাপিত করেছেন, যার মাধ্যমে পাঠকের মনকে ভক্তিতে ভরিয়ে দিতে পেরেছেন। এছাড়াও বিদ্যাপতি তার বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধা কৃষ্ণের যে আবেগ অনুভূতির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন যা পাঠকের মনে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে।

বিদ্যাপতি এই সাহিত্যকর্ম বাংলা, মৈথিলী এবং ওড়িয়া সাহিত্য গভীর প্রভাব ফেলেছে। তার লেখা রচনা গুলি পরবর্তীতে অন্যান্য কবিদেরও অনুপ্রাণিত করেছে। বিদ্যাপতির “কীর্তিলতা” নামক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রয়েছে, যেখানে তিনি মিথিলার তৎকালীন রাজা কীর্তিসিংহের প্রশংসা করেছেন।

বিদ্যাপতির পদাবলী রচনা গুলি বৈষ্ণব ধর্ম প্রভাবিত করেছিল আর তার জন্য শ্রীচৈতন্যদেব তার এই রচনার খুবই কদর করতেন, যার ফলে বৈষ্ণব ধর্ম ব্যাপক হারে প্রচার পেয়েছিল।

বিদ্যাপতির পদাবলী সাহিত্য এতটাই সহজ-সরল ভাষায় বর্ণিত ছিল, যার ফলে ভারতীয় সাহিত্য জগতে বিদ্যাপতির পদাবলী এক বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছিল। তাঁর রচনার মধ্যে এতটাই ভক্তি রস ছিল, যা মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল আজও সাহিত্যিক, সাধারণ মানুষের মননে এবং বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির পদাবলী একইভাবে অনন্য হয়ে রয়েছে।

Leave a Comment

Join Group Join Group